আমার ফাউন্টেন পেন, কালি, ক্যালিগ্রাফি এসব নিয়ে আগ্রহ কিভাবে শুরু তা নিয়ে আজকের গল্প। প্রথমেই বলে রাখি যে এধরণের লেখালেখির অভিজ্ঞতা একদম নেই বললেই চলে, তারপরও চেষ্টা। সত্যি কথা বলতে আমার ফাউন্টেন পেনের সাথে সম্পর্ক বোধহয় খুব বেশি দিনের বলা যাবে না। ছোটবেলায়, সময়টা আশির দশকের মাঝামাঝি, নিজে কখনও ফাউন্টেন পেন ব্যবহার করিনি, সব সময়ই বলপেন দিয়ে লিখেছি। তবে বড় ভাই-বোন কয়েকজনকে দেখেছি তখনও ফাউন্টেন পেন ব্যবহার করতে। সেই সুবাদে এক ধরণের কৌতূহল ছিল এই ফাউন্টেন পেন নিয়ে, মনে আছে অনেক সময় ফাউন্টেন পেন দেখলে লেখার চেষ্টা করতাম, কিভাবে নিব দিয়ে তরল কালীটা বের হচ্ছে তা খুব আশ্চর্য লাগতো। আবার নিবটাও দেখতাম অন্যান্য কলম থেকে একদমই ভিন্ন। আমার বাবা সরকারি চাকুরী করতেন, তিনি প্রচুর ফাউন্টেন পেন ব্যবহার করতেন। ওনার অফিসে গেলে দেখতাম টেবিলের উপর ডেস্কপেন, ডেস্কপেনের শেপটা খুব ইন্টারেস্টিং লাগতো তখন। বাবার একটা ব্যক্তিগত কলমের কালেকশান ছিলো, এগুলো মাঝে মাঝে খুলে দেখতাম। তারপর অবশ্য বড়ো হওয়ার সাথে সাথে এই কৌতূহল ধীরে ধীরে কমতে থাকে। এক সময় ফাউন্টেন পেনের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভুলেই যাই।
অনেক বড় হওয়ার পর, দুই হাজার দশ সালের দিকে আমি প্রথম ফাউন্টেন পেন দিয়ে লেখা শুরু করি। প্রথম চাকুরীতে জয়েন করেছি তখন। বাবার কালেকশান থেকে একটা পার্কার জটার ফাউন্টেন পেন নিয়ে সেটা দিয়ে লেখালেখি শুরু করলাম। আমি শিক্ষকতা পেশার সাথে জড়িত, তাই সাধারণত বেশ কিছুটা হাতে লেখালেখির প্রয়োজন হতো, বিশেষ করে লেকচার তৈরী করতে হতো প্রায় প্রতিদিনই। বাবার এই জটার পেন আর পাইলট ব্ল্যাক ইংক ব্যবহার করেছি প্রায় তিন-চার বছর। ২০১৩ সালের পর বেশ কয়েক বছর জার্মানিতে থাকি চাকুরীর সুবাদে। সেখানে অনেক ব্র্যান্ডের কালি, কলম দেখতাম দোকানে গেলে, লামি, ওয়াটারম্যান, পিলিকান, কাভেকো। লেখালেখির কাগজ দেখতাম রোডিয়া, ক্লেয়ারফন্টেইন, লয়েশতুরম, আরো কত কি। একদিন একটা লামি সাফারি কিনে ফেলি। ব্যাস! এরপর মাঝে মাঝেই, যখনি সম্ভব হত, কলম আর কালি কেনা। খুব একটা অবশ্য কেনা হতো না, দোকানে ঘুরাঘুরিই হতো বেশি। একটা পিলিকান M205 কিনেছিলাম যেটা দিয়ে লেখার অনুভূতি লামির তুলনায় স্বর্গের মতো লাগতো। এসময় ইউটিউবে Pen Habit, Sbrebrown, Brian Goulet, Figboot on Pens চ্যানেলের ভিডিও দেখতাম প্রচুর, এই সময়টাতেই বলা যায় আমার ফাউন্টেন পেনের ব্যবহারটা মোটামুটি শেপ নেয়।
ইউটিউবের ফাউন্টেন পেন রিলেটেড ভিডিওগুলি দেখতে দেখতেই একদিন হটাৎ করেই ক্যালিগ্রাফির ভিডিও দেখা শুরু, সম্ভবত ২০১৮-র শেষের দিকে। ধীরে ধীরে ক্যালিগ্রাফি মাস্টার্স চ্যানেলটা খুব পছন্দের হয়ে ওঠে, বিভিন্ন দেশের ক্যালিগ্রাফারদের কাজ সম্পর্কে জানতে পারি, যেমন সাচিন শাহ, লালিত মুরিয়া, পল এন্টোনিও, মায়াঙ্ক, স্লো লি এবং আরো অনেকে। এদের ভিডিও দেখেই একটা পাইলট প্যারালেল কলম কিনি আর তারপর থেকেই ক্যালিগ্রাফির নেশা। বিশেষ করে ব্রডএজ ক্যালিগ্রাফির দিকে আগ্রহ বাড়ে আমার, ক্রমশ বুঝতে পারি যে আমার জন্য এটা ফাউন্টেন পেনের চেয়েও বড় নেশায় পরিণত হচ্ছে। আরও দুইটা জিনিস উপলব্ধি করি - ফাউন্টেন পেনের কালির নতুন ব্যবহার খুঁজে পাই আমি ক্যালিগ্রাফিতে আর এটা আমার জন্য এক ধরণের escape। ক্যালিগ্রাফি শেখার সময়টা আমার এক ধরণের personal time অথবা হবিও বলা যায়। উপলব্ধি করি যে জীবনের একটা বড় সময় চলে গিয়েছে পড়াশুনা আর জীবন গড়ার ব্যস্ততায়, জীবন কেটেছে "লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে" ধরণের কথা শুনে। কিন্তু এখন মাঝেমাঝেই মনে হয় নিজের মনের শান্তির জন্য কিছু সময় বের করতে হবে। এসব মিলিয়েই আমার ক্যালিগ্রাফি শেখার গল্প। এদিকে ফেসবুকে ফাউন্টেন পেন গ্রূপগুলিতে অনেকেই আমার কাজ দেখে খুব প্রশংসা করেন, এতে ভীষণ ভালো লাগে, আগ্রহ আরো অনেক বেড়ে যায়। অবশ্যই এক্ষেত্রে সবাইকে অশেষ ধন্যবাদ, এতটা প্রশংসা পাবো আসলেই কোনোদিন ভাবিনি। গত কয়েক মাস ধরে আবার আইটালিক হ্যান্ডরাইটিঙের দিকে অনেক ইন্টারেস্ট পাচ্ছি। এখনো প্রধানত পাইলট প্যারালেল আর আইটালিক ফাউন্টেন পেন, যেমন পাইলট প্রেরা, মেট্রোপলিটান, শেফার ক্যালিগ্রাফি পেন ইত্যাদি, দিয়েই শেখা হচ্ছে বেশি। তবে ডিপ নিব দিয়ে শেখার আগ্রহ আছে ভবিষ্যতে।
তানভীর হুসেইন
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং মাস্টার ক্যালিগ্রাফার
Leave a comment